আয়ুর্বেদিক ওষুধ সম্বন্ধে জানতে চাই,আয়ুর্বেদিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া,আয়ুর্বেদিক ঔষধের উপকারিতা।
আয়ুর্বেদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস
এ যুগে অধিকাংশ লোকই আয়ুর্বেদ বা গাছগাছড়া দিয়ে চিকিৎসায় বিশ্বাস করেন না। প্রাকৃতিক এই মহাশক্তির ওপর অনেকের আস্থা নেই । অনেকেই আয়ুর্বেদকে সন্দেহের চোখে দেখেন। প্রাকৃতিক এ চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে বিভ্রান্তিও কম নেই। আবার অনেকে ভেষজ চিকিৎসা বা ঔষধি গাছের ওপর নির্ভর করেন, orবিশ্বাস করেন। বিশেষ করে যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ সীমিত বা নেই সেখানে ভেষজ চিকিৎসা প্রবল প্রতাপে টিকে আছে । আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বা ঔষধি গাছের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে অনেকটা লোকবিশ্বাসের ওপর ভর করে । আয়ুর্বেদ নিয়ে সাধারণ মানুষের যেসব প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস-অবিশ্বাস রয়েছে সেসব কিছু বিষয় নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
ধারণা ১ : আয়ুর্বেদ একটি সেকেলে চিকিৎসাপদ্ধতি দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই বিশেষত তরুণ সমাজ এ ধারণার বশবর্তী। তারা মানতেই চায় না, গাছগাছড়ার অসুখবিসুখ সারানো বা প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতা আছে। কিন্তু আয়ুর্বেদশাস্ত্রের যদি কোনো কার্যকারিতা না থাকত তাহলে প্রায় ৫০০০ বছর আগে সৃষ্টি হওয়া আয়ুর্বেদশাস্ত্রের চিকিৎসাপদ্ধতি কী করে এতদিন পৃথিবীতে টিকে থাকল? যদি এ পদ্ধতিতে কোনো কাজ না হতো, তাহলে এই বিদ্যা নিয়ে কেউ পড়াশুনা করত না, চিকিৎসা করত না এবং তা সমাজে বহমান থাকত না । প্রাচীন ভারতবর্ষে গাছগাছড়া থেকে বহুরকমের ঔষধ তৈরি হতো, এখনো হয়। ঔষধ তৈরির আদিরূপ হলো আয়ুর্বেদশাস্ত্র। শুধু ঔষধ তৈরিই নয়, প্রাচীনকালে এই শাস্ত্রমতে শল্যচিকিৎসা বা সার্জারি কাজও করা হতো। প্রায় ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এ কাজ করতেন সুশ্রুত। প্রাচীন বিশ্বে তিনি ছিলেন একজন অন্যতম শল্যচিকিৎসক। তবে এ কথা সত্য যে, মধ্যযুগের পর থেকে আধুনিক
ঔষধসমূহের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গেছে। তথাপি এখনো আধ্যাত্মিকতা, খাদ্যেও পথ্য-অপথ্য বাছবিচার, সামগ্রিকভাবে শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপনের জন্য এ যুগেও আয়ুর্বেদ অনেকের কাছে জনপ্রিয়। বরং উন্নত বিশ্বে সচ্ছল ও দরিদ্রদের মধ্যে হার্বাল চিকিৎসার প্রবণতা বাড়ছে। এখন হার্বাল চিকিৎসা অনেক আধুনিক হয়েছে।
ধারণা ২ : আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই অনেকেরই ধারণা, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও ঔষধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই । এ কথা সত্য যখন সেই চিকিৎসা নির্ভুল হয় ও ঔষধ সঠিক মাত্রায় ও নিয়মে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু চিকিৎসা ভুল হলে ও মাত্রানুযায়ী ঔষধ গ্রহণ না করলে তা বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সেইসাথে কিছু খাদ্য খাবারেরও বাছবিচার থাকে। সেসব না মানলে ঔষধের কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, গুগুলা (Commiphora wightii) খালি পেটে যদি খাওয়া হয় তবে তাতে অ্যাসিডিটি বা অম্বল বেড়ে যায়। পক্ষান্তরে, যদি তা খাবারের সাথে দুধপান করে তারপর খাওয়া হয় তাহলে আর এ অসুবিধাটা হয় না । তাই অভিজ্ঞ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যেন তেনভাবে আয়ুর্বেদিক ঔষধ গ্রহণ না করা ভালো ।
ধারণা ৩ : শুধু গাছগাছড়া দিয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করা হয় শুধু গাছগাছড়া দিয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করা হয়, এ ধারণা সঠিক নয় । আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মূল উপাদান গাছগাছড়া এ কথা সত্য। তবে এর সাথে দুধ, ঘি, মাখন, মধু, তেল ইত্যাদিও যোগ করা হয়। সেইসাথে যোগ ব্যায়ামের মতো বিষয়কেও বিবেচনায় রাখা হয় ।
ধারণা ৪ : আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা খুব একটা কার্যকর নয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার ফলাফল রাসায়নিক ঔষধের মতো দ্রুত দেখা যায় না, এক সত্য। আয়ুর্বেদিক ঔষধ দেহে কাজ করে ধীরগতিতে যা রোগের মূল উৎপাটন করে রোগকে চিরতরে নির্মূল করে যা রাসায়নিক ঔষধ অনেক ক্ষেত্রেই পারে না। এজন্য অনেকেই আয়ুর্বেদিক ঔষধ ও চিকিৎসার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে।
ধারণা ৫ : আয়ুর্বেদ সব ধরনের অসুখ সারাতে পারে না সকল চিকিৎসাশাস্ত্রেই বলে রোগ নির্ণয় যত দ্রুত সম্ভব হয়, রোগ তত তাড়াতাড়ি ও সহজে সারানো যায়। সব রোগ সারানোর কোনো ঔষধ আসলেই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আয়ুর্বেদে এমন কিছু বিধান আছে যা দিয়ে এমন কিছু রোগ নিরাময় করা যায় যা অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ দিয়ে সম্ভব নয় । যেমন- ডায়াবেটিস ও পারকিনসনস রোগ।
ধারণা ৬ : আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় খরচ কম যে-কোনো সাধারণ মানুষ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারেন । কেননা, প্রকৃতি থেকে এই চিকিৎসার উপাদান সংগৃহীত হয়। এজন্য এর খরচ খুব কম লাগে। এমনকি বাজারে যেসব আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরি করে বিক্রি করা হয় তার দামও কম। তাই যদি কেউ এর উলটো বলেন, সেটাই বিস্ময়কর লাগে। শুধু ঔষধ তৈরির উপকরণই নয়, এ নিয়মে চিকিৎসা করাতে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার মতো অত পরীক্ষানীরিক্ষার দরকার হয় না, খরচও বাঁচে। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে রোগ নির্ণয় করা হয় রোগের কিছু উপসর্গ ও লক্ষণ দেখে। এমনকি প্রায় ক্ষেত্রে চিকিৎসককে কোনো ফি বা টাকা দিতে হয় না।
ধারণা ৭ : আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা অযোগ্য অনেকেই মনে করেন, এমবিবিএস ডাক্তারদের মতো আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা যোগ্য নন, হাতুড়ে চিকিৎসা করেন। গ্রামে আয়ুর্বেদিক ডাক্তাররা কবিরাজ নামে পরিচিত । কিন্তু প্রাচীনকালের সেসব আয়ুর্বেদিক শিক্ষা যে কবেই উঠে গেছে সে খবর আমরা অনেকেই রাখি না। আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ওপর সাড়ে চার বছর লেখাপড়া করে এখন চিকিৎসকদের ডিগ্রি নিতে হচ্ছে। সেসব লেখাপড়ার মধ্যে থাকছে Internal Medicine (কায়াচিকিৎসা), Diseases above the shoulder (শালকা), Surgery শল্যচিকিৎসা), Psychiatry (ভূতবিদ্যা), Toxicology (অগদতন্ত্রম ), Rejuvenation (রসায়নাম), Pediatrics (কৌমারঐত্যম) ও Aphrodisiacs (বাজিকরনাম)। এসব বিদ্যা রপ্ত করে শিক্ষা সমাপনের পর তাদের আবার এক বছর শিক্ষানবিশ বা ইন্টার্নি করতে হয়। ভালো শিক্ষা ভালো চিকিৎসক তৈরি করতে সাহায্য করে। কাজেই এখন আর আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের অযোগ্য ভাবা ঠিক হবে না।
ধারণা ৮ : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরে আয়ুর্বেদ অচল অনেকের ধারণা, কবিরাজি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শুধু আমাদের দেশে ও ভারতবর্ষে আছে। কেউ কেউ স্বীকার করতে রাজি নন যে এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরে কোনো দেশে আছে। কিন্তু সত্য এই যে, পৃথিবীর বহুদেশে বর্তমানে হার্বাল চিকিৎসা তথা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা প্রসারলাভ করেছে। সেসব দেশে হার্বাল ঔষধ তৈরির কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, কাউন্সিল ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) আয়ুর্বেদিক ঔষধকে সনাতন ও বিকল্প ঔষধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ।
ধারণা ৯ : আয়ুর্বেদিক ঔষধের কখনো মেয়াদ শেষ হয় না এটা আশ্চর্যের ব্যাপার যে, কেউ ভাবেন আয়ুর্বেদিক ঔষধের মেয়াদ কখনো পার হয় না বা নষ্ট হয় না। অন্য সব ঔষধের মতো আয়ুর্বেদিক ঔষধেরও একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। কিছু বড়ি হয়তো দুই বা তিন বছর পর্যন্ত সেবন করা যেতে পারে। তবে বেশিরভাগ ঔষধের মেয়াদ এক বছরের বেশি থাকে না । তাই দোকান থেকে ঔষধ কেনার আগে লেবেল ভালো করে পড়ে নিতে হবে।
ধারণা ১০ : আয়ুর্বেদিক ঔষধ খুবই বিস্বাদের অনেকেই বলেন, আয়ুর্বেদিক ঔষধ খুবই বিশ্বাদের কথা একেবারে মিথ্যে নয় । কেননা, আয়ুর্বেদিক ঔষধ সাধারণত যেসব গাছগাছড়া থেকে তৈরি করা হয় সেসব গাছের স্বাদ খুব মধুর নয়। বরং তিক্ত ও কইষট্যা। যে কারণে অসুখ সারে। কিন্তু কিছু স্বাদু ঔষধও আছে। বিশেষ করে শিশুদের খাওয়ানোর জন্য যেসব ঔষধ তৈরি করা হয়। এসব ঔষধের মধ্যে গুঁড়া আকারে পাওয়া যায় চূর্ণ, ঘি থেকে তৈরি হয় ঘৃত, আভালেহ যা চকলেটের মতো ও রসায়ন বা টনিক।
ধারণা ১১ : আয়ুর্বেদিক ঔষধ খেলে গরম বেশি লাগে ঔষধ খেলে দেহে তাপ বেড়ে যায় এ কথা সর্বাংশে সত্য নয়। বরং আয়ুর্বেদিক ঔষধ দেহে তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে। কিছু ঔষধ খাওয়ার পর হয়তো সাময়িকভাবে দেহে তাপ অনুভূত হতে পারে। তবে সবাই তা বোধ করেন না কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তা চলে যায় ।
ধারণা ১২ : আয়ুর্বেদিক ঔষধ সেবনে অনেক খাদ্যের বাছবিচার করতে হয় এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই যে আয়ুর্বেদিক ঔষধ খেলে এটা খাওয়া যাবে না ওটা খাওয়া যাবে না। তবে সাধারণভাবে অ্যালোপ্যাথিক ঔষধের ক্ষেত্রেও যেসব খাবার খেতে নিষেধ করা হয়,আয়ুর্বেদিক ঔষধের বেলাতেও তাই। যেমন- কারো ডায়াবেটিস হলে তাকে নিশ্চয়ই কোনো চিকিৎসক ঔষধ সেবনের পাশাপাশি মিষ্টি বা চিনি খেতে বলবেন না, অ্যালার্জি হলে পুঁইশাক খেতে বারণ করতে পারেন।
ধারণা ১৩ : আয়ুর্বেদশাস্ত্র বিজ্ঞানসম্মত নয় অনেকেই আয়ুর্বেদকে বিজ্ঞান হিসেবে মানতে রাজি নন। বিজ্ঞান কী? বিজ্ঞান হলো বিশেষ জ্ঞান। আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও পাতায় পাতায় বিজ্ঞানের সেসব বীজ প্রোথিত আছে । আছে এর নামের মধ্যেও। আয়ুর্বেদ কথাটি এসেছে 'আয়ুস' ও ‘বেদ' শব্দ দুটি থেকে । আয়ুস অর্থ জীবন, বেদ অর্থ জ্ঞান । আয়ুর্বেদ হলো জীবনের বিজ্ঞান, দেহ-মনকে ভালো রাখার বিশেষ কৌশল। প্রাচীন আয়ুর্বেদে দেহ, মন ও আবেগকে সংযুক্ত করে এই বিজ্ঞানকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
ধারণা ১৪ : আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শুধু বয়স্কদের জন্য আয়ুর্বেদ প্রাচীন শাস্ত্র হতে পারে, তাই বলে এটা শুধু প্রাচীন বা বয়স্কদের জন্যই প্রযোজ্য হবে এমন কোনো মানে নেই। বয়সের কোনো বাছবিচার নেই । যে-কোনো বয়সের লোক এ চিকিৎসা নিতে পারেন ।